cropped-Icon.png
Loading ...
বৃহঃ. এপ্রি ১০, ২০২৫
ছবি: ৭ই মার্চের ভাষণের ছবি

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লক্ষ লক্ষ জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর এই কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন তীব্রতর হয়, যা একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা দেখায় এবং টালবাহানা করতে থাকে। একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। এতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালি জাতি। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল ডাকার ঘোষণা দেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের বিশাল জনসমুদ্রে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সেখানেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন।

প্রতীক্ষিত সেই দিন আসে ৭ মার্চ। লাখো জনতা জড়ো হয় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেন। ফাল্গুনের সূর্য তখনও মাথার ওপর। মঞ্চে এসে তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন এবং দরাজ কণ্ঠে ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…’

এরপর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে কেনা যায়নি, ভয় দেখিয়ে দমানো যায়নি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি।’

তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং নিরপরাধ বাঙালির ওপর হামলা ও হত্যাযজ্ঞের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই— আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’

এ ভাষণে তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, এটি ছিল মূলত স্বাধীনতা সংগ্রামের গ্রিন সিগন্যাল। ছাত্র-জনতা তাঁর ভাষণ শুনে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। বাঙালির হৃদয়ে জ্বলে ওঠে প্রতিরোধের আগুন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশের প্রতিটি স্তরে সংগঠিত হতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।

এই ভাষণ শুধু একক কোনো মুহূর্তের বার্তা ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল এটি অনুপ্রেরণার মূল ভিত্তি। এই ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীকালে ইউনেস্কোর “মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড” আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। ৭ মার্চের এই ভাষণ আজও বাঙালির অস্তিত্বে জাগ্রত, স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় উজ্জ্বল মাইলফলক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *